ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্পে এ পর্যন্ত নরসিংদী, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে কমপক্ষে ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক মানুষ। শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে অনুভূত হওয়া এই ভূমিকম্পকে বিশেষজ্ঞরা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বলে আখ্যা দিয়েছেন। নরসিংদীর মাধবদীতে ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫.৭।
এর মাত্র ২৪ ঘণ্টা না যেতেই একই এলাকায় আবারও ৩.৩ মাত্রার আরেকটি কম্পন অনুভূত হয় শনিবার (২২ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে। টানা কম্পনের ঘটনায় ভূমিকম্প নিয়ে জনমনে উদ্বেগ বেড়েছে। সামনে বড় কিছু ঘটতে পারে—এমন আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ: তিন টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষস্থলে
আবহাওয়া অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট গবেষকরা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশ মূলত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত—
১. ইন্ডিয়ান প্লেট
- বাংলাদেশের প্রায় পুরো অংশই এই প্লেটের পূর্ব-উত্তর পাশে।
- উত্তরে ইউরেশিয়ান এবং পূর্বে বার্মা প্লেটের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।
২. ইউরেশিয়ান প্লেট
- বাংলাদেশের উত্তরের হিমালয় অঞ্চলে বিস্তৃত।
- ইন্ডিয়ান প্লেটের সঙ্গে সংঘর্ষে বড় ভূমিকম্পের প্রধান উৎস তৈরি হয়।
৩. বার্মা মাইক্রোপ্লেট (Burma Microplate)
- বাংলাদেশের পূর্বদিকে মিয়ানমার অঞ্চলে অবস্থিত।
- সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ইন্দো-বার্মা মেগাথ্রাস্ট এখানেই অবস্থিত।
দেশের প্রধান সক্রিয় ফল্ট ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি
বাংলাদেশের ভেতরে ও সীমান্ত বরাবর কয়েকটি বড় সক্রিয় ফল্ট রয়েছে। যেগুলো দেশের ভৌগোলিক অবস্থাকে অত্যন্ত সংবেদনশীল করে তুলেছে।
১. দৌকি ফল্ট (Dauki Fault)
- অবস্থান: সিলেট–মেঘালয়ের পাদদেশ
- ধরন: বড় থ্রাস্ট ফল্ট
- ঝুঁকি: রিখটার স্কেলে ৭–৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প
- প্রভাবিত জেলা: সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার
২. মধুপুর/মধবপুর ফল্ট (Madhupur Fault)
- অবস্থান: টাঙ্গাইল–ময়মনসিংহ–গাজীপুর অঞ্চলের পশ্চিমে
- ঝুঁকি: এম ৬.৫–৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় বড় ধাক্কা লাগতে পারে
- প্রভাবিত জেলা: টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, ঢাকা
৩. চট্টগ্রাম ফোল্ড বেল্ট ফল্টসমূহ
- অবস্থান: পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল
- ধরন: বহু সক্রিয় ফল্ট
- প্রভাবিত জেলা: চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার
৪. ইন্দো-বার্মা মেগাথ্রাস্ট (Subduction Zone)
- অবস্থান: বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্তের পূর্বে
- ধরন: এশিয়ার অন্যতম বড় সাবডাকশন ফল্ট
- ঝুঁকি: ৮.৫ বা তার বেশি মাত্রার বিধ্বংসী ভূমিকম্পের সম্ভাবনা
- প্রভাবিত জেলা: কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
৫. শিলং প্লাটো সীমান্ত ফল্ট
- অবস্থান: ভারতের শিলং–মেঘালয় উচ্চভূমি
- ঝুঁকি: ১৮৯৭ সালের মতো বড় ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি হতে পারে
- প্রভাবিত জেলা: সিলেট, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ
৬. তিস্তা ও প্লায়া–গঙ্গা লাইনামেন্ট
- অবস্থান: উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল
- ঝুঁকি: তুলনামূলক কম
- প্রভাবিত জেলা: রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও
দেশজুড়ে ভূমিকম্পের ঝুঁকির স্তর
বিশেষজ্ঞদের মতে, সমন্বিত ঝুঁকি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়—
প্রথম স্তর (অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকি):
ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, গাজীপুর
দ্বিতীয় স্তর (উচ্চ ঝুঁকি):
মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, শেরপুর, সুনামগঞ্জ, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, ফেনী
তৃতীয় স্তর (মাঝারি ঝুঁকি):
রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল
টানা ভূমিকম্পের ঘটনা ও সক্রিয় ফল্টগুলোর অবস্থান বাংলাদেশকে ভূমিকম্প-সংকটাপন্ন দেশে পরিণত করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরায়নের অনিয়ম, দুর্বল ভবন কাঠামো এবং প্রস্তুতির অভাবে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি ভয়াবহ হতে পারে।
প্রস্তুতি ও সতর্কতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

