নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিল্লুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের পথে এখন সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় হলো ‘জুলাই জাতীয় সনদ’। ২০২৪ সালের লাল জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের রক্তঝরা পটভূমি থেকে উদ্ভূত এই সনদ যেন নতুন রাষ্ট্র কাঠামোর মানচিত্র হলেও, জনগণের প্রত্যাশা ও বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে একটি বড় ফাঁক তৈরি হয়েছে।
সোমবার (২৭ অক্টোবর) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত আলোচনায় তিনি এসব মন্তব্য করেন।
জিল্লুর রহমান বলেন, জুলাই সনদের কেন্দ্রীয় দুই প্রশ্ন এখন সংবিধান সংস্কার “কবে” এবং “কীভাবে” হবে। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী আগামী জাতীয় সংসদই সংস্কার পরিষদের ভূমিকা পালন করবে, আর ৯ মাসের মধ্যে সংস্কার বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সংসদ ব্যর্থ হলে কী হবে, সে বিষয়ে কমিশনের কোনো স্পষ্ট উত্তর নেই।
তিনি বলেন, গণভোটে সাংবিধানিক আদেশ অনুমোদিত হলেও বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা অনিশ্চিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, কমিশনের নির্দেশনাগুলো বাধ্যতামূলক করা না হলে সনদ বাস্তবে কার্যকর হবে না।
আলোচনায় জিল্লুর রহমান তিনটি বিকল্প পথের কথা উল্লেখ করেন—
১️ ৯ মাসের মধ্যে ব্যর্থ হলে সংসদ বিলুপ্ত ও নতুন নির্বাচন;
২️⃣ নির্দিষ্ট সময় পার হলে স্বয়ংক্রিয় সংবিধান সংশোধন (যা রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য);
৩️⃣ নির্বাচনের আগে পরিষদ গঠন, পরে সংসদ।
তিনি মনে করেন, বাস্তবে কমিশন সম্ভবত নির্দেশনামূলক পথেই এগোবে— অর্থাৎ সইকারী দলগুলো ক্ষমতায় এলে সনদের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে।
জন আস্থার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যে সনদ হাজার শহীদের রক্তের ঋণে জন্ম নিয়েছে, তার বাস্তবায়ন কি ক্ষমতাসীন দলের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে, নাকি নাগরিকদের হাতে একটি বাধ্যতামূলক কাঠামো তুলে দেওয়া উচিত ছিল?”
জিল্লুর রহমান জানান, বিএনপি ও সমমনাদের ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ বা আপত্তি জুলাই সনদের আরেকটি বড় রাজনৈতিক জট তৈরি করেছে। উচ্চকক্ষ গঠনসহ ৯টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে তাদের আপত্তি রয়েছে, যা পুরো প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, “জুলাই সনদ কি সত্যিই সেই লাল জুলাই আন্দোলনের বৈষম্যবিরোধী দাবিগুলো পূরণ করেছে?” ৮৪টি সুপারিশের মধ্যে কৃষি, ভূমি, বাজার, শ্রমিক অধিকার, নারী অংশগ্রহণ ও তরুণদের কর্মসংস্থান–সংক্রান্ত প্রস্তাব প্রায় অনুপস্থিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জিল্লুর রহমান বলেন, অধ্যাপক ইউনূসের ‘থ্রি জিরো’ নীতির প্রতিফলনও এই ঐতিহাসিক দলিলে দেখা যায়নি। নারী অংশগ্রহণের অভাব, পুলিশ সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যর্থতা এবং প্রশাসনিক জবাবদিহির ঘাটতি—এসব কারণে সনদের বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
তিনি অবিলম্বে প্রশাসনিক আদেশেই বাস্তবায়নযোগ্য ৪০টি সুপারিশ কার্যকর করার আহ্বান জানান এবং বলেন, “জুলাই সনদের সঠিক স্নায়ু হলো কর্ম, কথা নয়।”
জামায়াত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “৭১–এর যুদ্ধাপরাধ উপেক্ষা করে কেবল ক্ষমা চাওয়াকে রাজনৈতিক পরিশুদ্ধতা বলা যায় না। পরিবর্তন আসে কর্ম ও নীতির ধারাবাহিকতায়।”
শেষে তিনি সতর্ক করে বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। বৈষম্য হ্রাস, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারী ও তরুণ নেতৃত্ব নিশ্চিত করা, জলবায়ু নিরাপত্তা—এই চারটি স্তম্ভই হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের মেরুদণ্ড।”
তিনি যোগ করেন, “ইতিহাস আমাদের হাতে আগুন তুলে দিয়েছে; এখন প্রশ্ন হলো—আমরা কি সেই আগুন দিয়ে আলোকিত পথ তৈরি করব, নাকি আবারও নিজেদের হাত জ্বালাব।”

