Wednesday, October 29

প্রতিদিন অফিস শেষে বাসায় ফেরার সময় ছোট্ট দুই সন্তান আব্দুল্লাহ ও ফারিস্থার জন্য জুস, ললিপপ, চিপস নিয়ে যেতেন বাবা আবুল কালাম আজাদ। সকালবেলা জামা-কাপড় পরে বের হওয়ার সময় ছুটে এসে সন্তানরা জিজ্ঞেস করত, “বাবা তুমি কোথায় যাবে?”—বাবা বলতেন, “অফিসে যাচ্ছি।” তখন তারা হাসিমুখে বলত, “আমরাও যাবো, আমাদের নেবে না?” বাবা প্রতিদিনের মতোই বলতেন, “এইতো রাতেই ফিরে আসবো, তখন জুস-ললিপপ আনবো।”

কিন্তু এবার সেই প্রতিশ্রুতি আর পূরণ হলো না।

আজ রবিবার (২৬ অক্টোবর) সকালে নারায়ণগঞ্জের পাঠানটুলী এলাকার বাসা থেকে রাজধানীর মতিঝিলের অফিসে এসেছিলেন আবুল কালাম আজাদ (৩৮)। দুপুরে কাজ শেষে ফার্মগেট এলাকায় এলে হঠাৎ মেট্রোরেলের একটি পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে তার উপর পড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।

দুই সন্তানের মুখ চেয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন আবুল কালাম। কিন্তু ফার্মগেটের ফুটপাতে পড়ে থাকা ১৪০ কেজি ওজনের সেই বেয়ারিং প্যাড মুহূর্তেই নিভিয়ে দিলো এক সুখী পরিবারের আলো।

দুর্ঘটনার পর স্থানীয়রা দ্রুত এগিয়ে এসে মরদেহটি তেজগাঁও থানায় নিয়ে যান। গণমাধ্যমে খবর দেখে সেখানে পৌঁছান নিহতের স্ত্রী আইরিন আক্তার প্রিয়া। স্বামীকে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে ভেঙে পড়েছেন তিনি। থানার ওয়েটিং রুমে বসে কান্না থামাতে পারছেন না প্রিয়া। তার কোলে বসে থাকা ছোট্ট আব্দুল্লাহ ও ফারিস্থা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি—তাদের বাবা আর কখনও ফিরবেন না।

আইরিন আক্তার প্রিয়া জানান, “প্রতিদিনের মতোই সকালে কিছু না বলে গোসল করে জামা পরে বেরিয়ে যায় ও। গতরাতে ২টার সময় কথা হয়েছিলো শেষবার। তখন বলেছিল, দুই সন্তান নিয়ে সুখী হতে চাই। ওদের ভবিষ্যৎ গড়তে আরও পরিশ্রম করতে হবে। কে জানতো, আজ সকালেই সেটাই হবে শেষ কথা!”

নিহতের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কিশোরকাটি গ্রামে। কর্মসূত্রে তিনি দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জে বসবাস করছিলেন। তিনি একটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে বিমানের টিকিটিং ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন।

দুর্ঘটনার পর সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রক্তের দাগ মুছে ফেলা হয়েছে। ক্রেন দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বিয়ারিং প্যাড মেরামতের কাজ করছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। বন্ধ রয়েছে ট্রেন চলাচল। এ সময় আহত শ্রমিক হেলাল দুই হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে ঘটনাটি বর্ণনা করেন সাংবাদিকদের কাছে।

তিনি বলেন, “দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে হঠাৎ বিকট শব্দ শুনি। ট্রেন যাওয়ার পরেই দেখি পিলারের দিক থেকে কিছু পড়ে যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখি একজন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মুহূর্তেই সব শেষ।”

মেট্রোরেল সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি পিলারের সঙ্গে রাবারের তৈরি বেয়ারিং প্যাড থাকে, যার ওজন প্রায় ১৪০-১৫০ কেজি। এগুলো ট্রেনের কম্পন সহনীয় করতে ব্যবহৃত হয়। ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর একই স্থানে আরেকটি বেয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল, তবে সেদিন কেউ হতাহত হয়নি।

এখন প্রশ্ন—প্রতিবারই এমন দুর্ঘটনার পর ধুলো মুছে সব ঠিকঠাক দেখানো হয়, কিন্তু মানুষের জীবনের নিরাপত্তা কোথায়?

ঢাকা শহরের ব্যস্ততম এলাকার ফুটপাতে এক অসচেতন মুহূর্তে হারিয়ে গেল এক বাবার জীবন, ভেঙে গেল এক পরিবারের ভবিষ্যৎ। এখনো হয়তো ছোট্ট আব্দুল্লাহ ও ফারিস্থা দরজার দিকে তাকিয়ে আছে—বাবা ফিরবে, হাতে থাকবে জুস-ললিপপ আর চিপস। কিন্তু তাদের বাবা আর কোনোদিন ফিরবেন না।

Leave A Reply


Math Captcha
− 2 = 5